বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
The Daily Post

কোটা আন্দোলনে নিহত বেওয়ারিশ মরদেহটি দেবিদ্বারের ফয়সালের 

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি

কোটা আন্দোলনে নিহত বেওয়ারিশ মরদেহটি দেবিদ্বারের ফয়সালের 

ধবধবে একটি সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। এমন একটি ছবি হাতে নিয়ে বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন নিহত ফয়সালের বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগম। তার আত্মচিৎকারের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। পাশে বসে কাঁদছেন ফয়সালের বাবাসহ তার ছয় বোন ও আত্মীয় স্বজন। তার শোকে কাঁদছেন প্রতিবেশীরাও। 

গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে ফয়সালের মা হাজেরা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের জীবনডারে কেউ ভিক্ষা দাও, আহারে আমার নিমাইরে এমনভাবে গুলি করছে যে মাথা মগজও উড়ে গেছে’। কোন পাষণ্ড আমার ছেলেকে এমনি গুলি করল, তার কি একটু হাত কাঁপল না’। 

তিনি আরও বলেন, পোলারে কত জায়গায় খুঁজছি, কেউ বলতে পারেনি কই আছে, থানায় গিয়েছি, এই হাসপাতালে, ওই হাসপাতালে ঘুরছি, কোথাও পাইনি, ১৩দিন পর জানছি, আমার ছেলেকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করছে, আমার মানিক চানরে কই দাফন করছে তাও কেউ জানে না। ‘কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সাল বইল্ল্যা ডাক দেবো তাও পারব না’, আহারে ফয়সালরে তুই গিয়া শুয়ে আছত’, আমার বুকে আয় বাবা। শনিবার (৩ আগস্ট) ফয়সালের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এমন আহাজারীর চিত্র।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ফয়সাল সরকার। ঘটনাটি ১৯ জুলাই সন্ধ্যায়। পরে ২২ জুলাই থেকে ২৫ জুলাইয়ের কোন একসময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ফয়সালকে ঢাকায় গণকবর দেয়া হয়। 

পরে ১ আগস্ট পরিবারের লোকজন জানতে পারেন ফয়সালকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। নিহত ফয়সাল সরকার কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের সরকার বাড়ির মো. সফিকুল ইসলাম সরকারের ছেলে। সে চলতি বছরে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। 

ইতোমধ্যে আট বিষয়ে পরীক্ষা শেষ করেছেন। পাশাপাশি সংসারের অভাব ঘুচাতে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা-মা, ভাইসহ পরিবার নিয়ে থাকতেন আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। 

নিহত ফয়সালের ছোট ভাই ফাহাদ সরকার বলেন, গত ১৯ জুলাই বিকেলে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যার পর ভাইয়ের নম্বরের ফোন করলে নম্বর বন্ধ পাই। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বাহিরে তখনও গোলাগুলি চলছিল। 

কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণ খান থানায় জিডি করি। গত ১২ দিন ঢাকার এই হাসপাতালে ওই হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেছি, কোথাও হদিস পাইনি। পরে ১ আগস্ট আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন 

করা মরদেহগুলোর ছবি দেখালে সেখানে ফয়সাল ভাইয়ের মরদেহের ছবি দেখতে পাই। কোথায় দাফন করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা জানায়, ১৫/২০টি মরদেহ একবারে গণকবর দেয়া হয়েছে, কাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে তারা তা জানেন না।

ফয়সালের বড় বোন রোজিনা আক্তার ও নুরুননাহার আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাদের ছয় বোনের পর এই ভাই, আপনারা আমার ভাইকে এনে দেন, আমরা কোন রাজনীতি করি না, আমাদের সংসার এখন কে চালাবে, আমাদের কী হবে। এই ভাই রোজগার করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা কানে শুনে না। 

নিহত ফয়সালের বাবা বৃদ্ধ মো. সফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, আমার ছয় মেয়ের পর ফয়সাল হয়েছে। এই ফয়সাল লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম সুপাইভাইজারের কাজ করে সংসার চালাত। এখন আমার পুরো সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। কারা আমার ছেলেকে হত্যা করল ? কি দোষ ছিল আমার ছেলের, সে তো কোন রাজনীতি করত না, পেটের দায়ে বাসে কাজ করত তাকে কেন গুলি করে মারা হলো ? এই বিচার আমি কার কাছে দেব? 

দেবিদ্বার ইউএনও নিগার সুলতানা বলেন, ১৩দিন পর ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি জানতে পেরেছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এর আগেও 
ঢাকায় নিহত কয়েকজনের বাড়িতে আমি গিয়েছি, সহযোগিতা করেছি। ফয়সালের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে, সরকারিভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।

টিএইচ